১।
কয়েকবছর আছে জার্মানির ট্যুবিঙ্গেন ইউনিভার্সিটিতে এক বক্তৃতা দেবার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল তসলিমা নাসরিনের লেখা ও কর্মতৎপরতা। বক্তৃতাটি শেষ পর্যন্ত দেয়া হয়ে ওঠেনি। কারণ প্রস্তাবদাতার যে প্রেমিজের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতার আধেয় আশা করছিলেন সেটার কিছু বিষয়ে আমার মতবিরোধ, এবং দোনমনা ছিল। প্রস্তাবদাতা অধ্যাপক তসলিমাকে বামপন্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলেন। আমার এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি ছিল। প্রথমত বামপন্থার মহাদেশীয় (অর্থাৎ ইয়োরোপীয়) সংজ্ঞা এবং (উপমহাদেশীয়) পরিচিতি এক নয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যা ব্যাতিরেকে এই শব্দ ব্যবহার না করা পক্ষে মত ছিল আমার। দ্বিতীয়ত, আমি সন্দিহান ছিলাম প্রগতিশীল/লিবারেল জাতীয় শব্দ ব্যবহার একই ধরণের সমস্যা তৈরি করবে কিনা। আলাপের এক পর্যায়ে বুঝে যাই প্রস্তাবদাতা অধ্যাপক আসলে আমি বক্তৃতায় তসলিমার সমালোচনা করি এরকম চাইছেন না। তিনি চাইছেন তসলিমার ইউরোপে যে পরিচিতি আছে সেটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে। অক্রিটিকাল এই বক্তৃতা প্রোপাগান্ডা হয়ে উঠতে পারে এই আশংকায় আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতাটি দেয়া থেকে বিরত থাকি।
এই কথাগুলো মনে পড়লো ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেখে। স্ট্যাটাসলেখক দাবি করেছেন বামপন্থী মানেই প্রগতিশীল এবং বামপন্থী না হলে লেখক হওয়া যায় না। এই মন্তব্যের ঠিকবেঠিক বিচারের আগে প্রগতিশীলতার বলবত সংজ্ঞা (operational definition) নির্ধারণ করে নেয়া জরুরী। এই সংজ্ঞা আলোচনায় প্রথমত এটা কীভাবে বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয়েছে এবং এটার এখনকার মানে কি মূল থেকে বিস্তৃত হয়েছে কিনা সেটা জানা দরকার।
আমার এখনো পর্যন্ত ধারণা উপমহাদেশে প্রগতিশীলতা শব্দ/ধারণাটির প্রচলন বামপন্থীদের (রুশমতে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণকারিদের) হাতে। যেমন প্রায় শতবছর আগে রুশ বিপ্লবের প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশে যখন পড়তে শুরু করে তখন লন্ডনে নিখিল ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘ (ইংরেজি Progressive Writers’ Movement in India) নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর পর থেকে বা বলা উচিৎ কাছাকাছি সময় থেকে রুশ সূত্র থেকে এবং রুশ প্রভাবিত সূত্র থেকে বিভিন্ন বাংলা অনুবাদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক টেক্সটে এই শব্দের দেখা মেলে। এই শব্দের বিপরীত হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল শব্দটাও দেখা যেতে থাকে।
প্রগ্রেসিভ রাইটার বা প্রগতি সাহিত্যিকদের কী ও কীভাবে লিখবেন সেই বিষয়েও কথা বার্তা হতে থাকে। প্রসঙ্গক্রমে ধনঞ্জয় দাশের আত্মজীবনী “আমার জন্মভূমিঃ স্মৃতিময় বাঙলাদেশ” বইয়ের কিছু অংশের কথা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ধনঞ্জয় দাশকে মনে করতে পারবেন এরকম মানুষ এখন কমে এসেছে। স্মর্তব্য, পাকিস্তান আমলে তিনি ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে আটক ছিলেন। সেই সময়ে তাঁর দিনপঞ্জিতে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পর্যালোচনা লিখে রেখেছিলেন। সেখানে দুটি পয়েন্ট এরকমঃ
১২। পুর্ববাঙলায় নতুন মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠছে। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও সক্রিয়।
১৩। পুর্ববাঙলার সাহিত্যে প্রগতিশীল ভাবধারা ক্রমান্বয়ে অগ্রসর।
ধনঞ্জয় তাঁর আত্মজীবনীতে “প্রগতি-সাহিত্যিক” শব্দবন্ধও ব্যবহার করেছেন। ৭০ বছর পর এই শব্দের অর্থের ব্যাপ্তি বিস্তৃত হয়েছে। এখন সেকুলার, বামপন্থী, সংস্কৃতি কর্মী সবাইকেই মোটা দাগে প্রগতিশীল বলে পরিচিয় করিয়ে দেয়া হয়।
২।
বাঙলা ব্লগের শুরুর দিকে ভাষার রূপ নিয়ে আলোচনা হতো। এই আলোচনায় অবশ্যম্ভাবী বিষয় হলো পূর্ব বাঙলার মানুষ যেভাবে বাঙলা বললে সেটা প্রমিত বাঙলা নয় কেন এই আলোচনা। এখানে এক অর্বাচীন এখন মধ্য পঞ্চাশ বয়স এরকম একজনকে কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনার অগ্রদূত হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। ধনঞ্জয় দাশের আত্মজীবনীতে এই বিষয়ে আলোচনা দেখলাম। অংশটা টুকে রাখি এখানে। এই লেখা অর্ধশতকের বেশি সময় আগে লেখা হয়েছে।
গল্প সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে এবার আমি একটি সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি পূর্ববাঙলার প্রগতি-সাহিত্যিকদের, বিশেষ করে গল্প-লেখকদের। সমস্যাটি হলো সাহিত্যের ও সংলাপের (Literary Language & Dialogue) সমস্যা। প্রকৃতপক্ষে, সাহিত্যের ভাষা ও সংলাপ নিয়ে সম্প্রতি পূর্ব-বাঙলার সাহিত্যিকদের মনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে বাঙলা-সাহিত্যের ভাষা রূপে স্বীকৃত গঙ্গা-ভাগীরথী তীরবর্তী মানুষদের কথ্য ভাষাকে তাঁদের কেউ কেউ সম্পূর্ন বর্জন করতে চাইছেন। অথচ আমরা জানি, ভাগীরথী-জনপদ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে পরিগণিত হওয়ায় (প্রধানত ঊনবিংশ শতাব্দীতে) এই জনপদের কথ্য ভাষা শক্তিশালী লেখ্য সাহিত্যিক ভাষায় উন্নীত হয়েছিল। এই সাহিত্যিক ভাষা-সৃষ্টিতে কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা সম্প্রদায়ের দাবী কোনোক্রমেই স্বীকার্য নয়। সমগ্র হিন্দু-মুসলমান বাঙালি জাতি মিলিতভাবে মনের ভাব সুষ্ঠু রূপে আদান-প্রদানের জন্য এই লেখ্য সাহিত্যিক ভাষার পুষ্টি ও সৌকর্য-সাধনে সমান ভাবেই দান করেছেন, এ-কথাটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একথা সত্যি যে, এই লেখ্য ভাষায় পূর্ববাঙলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সংলাপকে অবহেলা করা হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু আজ যদি এই অবহেলার মূল কারণগুলি অনুসন্ধান না করে এতদিনের অবদান-পুষ্ট সাহিত্যিক ভাষার পরিবর্তে পূর্ববাঙলার আঞ্চলিক ভাষা ও সংলাপকে যথেচ্ছভাবে সাহিত্যে আমদামী করতে শুরু করি তবে আমরা এক অন্ধ সঙ্কীর্ণতাবাদের দিকেই পা বাড়াতে বাধ্য হবো।
সম্প্রতি পুর্ববাঙলায় এই বিপদ ডেকে আনছেন একদম অন্ধ সংস্কারাচ্ছন্ন স্বার্থবাদী মানুষ। পূর্ববাঙলার প্রগতিসাহিত্যিকদের যথেষ্ট সতর্কতা নিয়ে দৃঢ়পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য। সময়স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া কোনোক্রমেই উচিৎ হবে না। আঞ্চলিক ভাষা ও সংলাপকে আমাদের আত্মস্থ করতে হবে নিশ্চয়, কিন্তু অন্ধভাবে নয়। এতে সাহিত্যের আবেদন সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, পুর্ব-বাঙলার বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলের ভাষা এবং সংলাপের মধ্যে এত বেশি পার্থক্য বিদ্যমান যে, এক অঞ্চলের ভাষা ও সংলাপ অন্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই দুর্বোধ্য। এছাড়া ভাষা ও সংলাপের সৌকর্য ও স্বরধ্বনির (Phonetics) বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগের দিকেই আমাদের ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করা উচিৎ। প্রগতি-সাহিত্যিকদের মনে রাখতে হবেঃ “কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী ভাষা সৃষ্টি করেনি। বহু শতাব্দীব্যাপী সমগ্র সমাজের ও সকল শ্রেণীর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে” – স্তালিন।
সমস্যাটি-যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ পেলাম জনাব ওয়াজেদ আলীর সাম্প্রতিককালের “সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারা” নামক প্রবন্ধে ‘পূর্ববাঙলার সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনটি দূর্ঘটনার কথা’ উল্লেখে একে অন্যতম স্থান দেওয়ায়। জনাব ওয়াজেদ আলী লিখেছেনঃ “আমাদের অনেক সাহিত্যিক বর্তমানে ভাষার কথ্যরূপ ব্যবহার করতে প্রলুব্দ হচ্ছেন। কিন্তু এটা যে কত বড় কঠিন কাজ, সে সম্বন্ধে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা আছে বলে মনে হয় না। পূর্ববাঙলায় বলা যায়, ভাষার এমন কোনো কথ্যরূপ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের আদর্শ কথ্যভাষার আদর্শ রূপ গ্রহণ করেই আপাততঃ আমাদের কাজ চালানো ছাড়া উপায়ান্তর নেই। কিন্তু সবাই দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছেন যে, আমাদের এই প্রদেশের খুব কম সংখ্যক সাহিত্যিক কথ্যভাষার এই আদর্শকে পরোয়া করে চলছেন। তাই অনেকের ভাষাতেই কথ্য ও লেখ্য ভাষার জগাখিচুড়ি তৈরী হচ্ছে এবং অন্য ভাবেও কথ্যভাষার আদর্শ ভেঙ্গে পড়ছে। একে কিছুতেই একটি সুলক্ষণ বলে মনে করা যায় না।”
(সওগাতঃ পৌষ, ১৩৫৯)
৩।
প্রতিবছর ইলা মিত্রের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ইলা মিত্রের জবাববন্দির আংশিক অংশ পূণঃপ্রকাশ করে মিডিয়াগুলো। ধনঞ্জয় দাশ পুরোটা তুলে রেখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। সেটা এরকম –
কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭.১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধোর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে এই বলে এসআই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পুর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দী করে রাখে।
আমাকে কোনো খাবার দেওয়া হয় নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যেবেলাতে এসআই-এর উপস্থতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত শুরু করে। সে সময়ে আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এর পর আমার কাপড়-চোপড় আমাকে ফেরত দেয়া হয় এবং রাত্রিপ্রায় বারোটার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবতঃ এসআই-এর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না।
যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালালো। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেয়া হচ্ছিলো এবং সে সময় চারিধারে যারা দাঁড়িয়েছিলো তারা বলছিলো যে আমাকে “পাকিস্তানী ইনজেকশন” দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একগটি রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিলো। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলছিলো। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিলো না।
সেলের মধ্যে আবার এস আই সেপাইদের চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিলো এবং বললো, “এবার সে কথা বলবে”। তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিত করে শুইয়ে রাখলো এবং একজন আমার যৌনঅঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ৯.১.৫০ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হলো তখন উপরোক্ত এস আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুটে করে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলো। এর পর আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেয়া হলো। সে সময়ে আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস আই-কে বিড়বিড় করে বলতে শুনলামঃ আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস আই এবং সিপাইরা ফিরে এলো এবং তারা আবার সেই হুমকি দিলো। কিন্তু আমি যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজী হলাম না তখন তিন-চার জন আমাকে ধরে রাখলো এবং একজন সিপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলো। এর অল্পক্ষণ পরেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। পরদিন ১০.১.৫০ তারিখে যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে এবং আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলো। নবাবগঞ্জ জেল গেটের সেপাইরা জোর ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটা সেলের ভেতর বহন করে নিয়ে গেল। তখনো আমার রক্তপাত হচ্ছিলো এবং খুব বেশী জ্বর ছিলো। সম্ভবতঃ নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের একজন ডাকটার সেই সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রী। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনলেন তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরো কম্বলও দেওয়া হলো। ১১.১.৫০ তারিখে সরকারী হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিলো সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলের একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশী জ্বর ছিলো, তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিলো এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। ১৬.১.৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হলো এবং আমাকে বলা হলো যে পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশী শরীর খারাপ থাকার জন্য আমার পক্ষে নড়াচড়া সম্ভব নয় একথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হলো এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এর পর আমাকে অন্য এক বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সেখানে কিছুই বলি নি কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে সই আদায় করলো। তখন আমি আধা-অচেতন অবস্থায় খুব বেশী জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিলো সেজন্য পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালে পাঠানো হলো। এর পর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলো তখন আমাকে ২১.১.৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো। কোনো অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলি নি এবং উপড়ে যা বলেছি তার বেশি আমার আর বলার কিছুই নেই।
আমার জন্মভূমিঃ স্মৃতিময় বাঙলাদেশ
ধনঞ্জয় দাশ
মুক্তধারা