ভারতবর্ষে রেলযাত্রার সূচনা ১৬ই এপ্রিল ১৮৫৩ সালে। ঐদিন মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে রেলযাত্রার সূচনা হয়। এর এক বছর পর ১৮৫৪ সালের ১৫ই অগাস্ট কলকাতায় রেল চালু হয়। গুগল করে সেই ট্রেনের কিছু ছবিও পেলাম [১]।
সেইসময়ে রেলএঞ্জিন বাষ্পচালিত ছিল। নতুন বাহন আসার উত্তেজনা তখনকার সমাজে বেশ ভালোরকমের ছিল এটা আন্দাজ করা যায়। অনভিজ্ঞতা ও উত্তেজনার মিশেলে দূর্ঘটনাও হতো। সেই সময়ে বিজ্ঞান লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০ – ১৮৮৬) রেল ভ্রমণ নিয়ে একটি ছোট বইও লিখেছিলেন। রেল/ট্রেনের বাংলা তিনি করেছিলেন “বাষ্পীয় রথ”। তাঁর লেখা বইটির শিরোনাম ছিল “বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ”। বইটির প্রচ্ছদ এরকম ছিল,
স্বাভাবিকভাবেই রেল/বাষ্পীয় রথ বিষয়ে অক্ষয়কুমারের মুগ্ধতা ছিল। তিনি লিখেছেন,
বাষ্পীয় রথ পরমাদ্ভুত বস্তু।
দ্রুতগতিতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে যাবার উপযোগিতা বর্ণনা করতে তিনি লিখেছেন,
উহা দ্বারা এক মাসের পথ এক দিবসে ভ্রমণ করিয়া অক্লেশে অশেষ বিষয়ের বাসনা সুসিদ্ধ করা যায়। উহা দ্বারা, দুর দেশীয় পণ্য সামগ্রী সকল অনায়াসে অবিলম্বে নানা স্থানে নীত হইয়া লোকের ভোগ-তৃষ্ণা চরিতার্থ করিতে পারে, স্বদেশ-দর্শনোৎসুক দুর-প্রবাসী ব্যক্তিরা বারম্বার স্বদেশ প্রত্যাগমন পূর্ব্বক পরম স্নেহভাজন স্বজন-বর্গের ও পরম প্রণয়াস্পদ সুহৃদ্বর্গের মুখাবলোকন করিয়া পুলকিত হইতে পারেন, এবং নৈসর্গিক শোভা-প্রিয় সহৃদয় মহাশয়েরা অল্প কালের মধ্যে অবলীলা-ক্রমে দেশ-বিশেষের ও স্থানবিশেষের বিভিন্ন শোভা সন্দর্শন করিয়া হৃদয়-পদ্ম বিকসিত করিতে পারেন। এক শতাব্দ পূর্ব্বে গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় ছয় মাসের পথ ছয় দিবসে উত্তীর্ণ হওয়া অতি বিস্ময়কর অসম্ভব ব্যাপার বিবেচনা করিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। (ফুটনোট)
অক্ষয়কুমার এই বইটি লিখেছিলেন ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ (১৭৭৬ শকাব্দ) সালে। তখন বাংলা গদ্য নিজের চেহারা পাচ্ছে। বাংলা গদ্যে বিস্তৃত যতিচিহ্নের প্রবর্তক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম উল্লেখ করা হলেও অক্ষরকুমার কমা, সেমিকোলন ইত্যাদির সর্বপ্রথম ব্যবহারকারীদের একজন।
নতুন গড়ে উঠতে থাকা গদ্যরীতিতে অক্ষয়কুমার বাষ্পীয় রথে ভ্রমণের ১৩টি নিয়মের বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন। সেগুলো এরকমঃ
প্রথম নিয়ম
যে সময়ে বাষ্পীয় রথ গমন করিতে থাকে, সে সময়ে তাহাতে আরোহণ ও তাহা হইতে অবতরণ করা কর্ত্তব্য নহে।দ্বিতীয় নিয়ম
বাষ্পীয় রথের অবৈধ স্থানে অবৈধ প্রকারে অবস্থান করা কর্তব্য নহে।তৃতীয় নিয়ম
যিনি যে স্থানে গমন করিবার উদ্দেশে বাষ্পীয় রথে আরোহণ করেন, সে স্থানে উপনীত না হইয়া তাহা হইতে অবতরণ করা তাঁহার পক্ষে শ্রেয়ঃ নহে। যদি কেহ কোন কারণে এই সুচারু বিধান সর্ব্বতোভাবে পালন করিতে নিতান্ত অশক্ত হন, তবে যাহাতে পথের মধ্যে অধিক বার অবতরণ করিতে না হয়, তাহার উপায় করিবেন।চতুর্থ নিয়ম
রথাবতরণের সময়ে, যে দিক্ দিয়া যেরূপে অবতরণ করিলে, কোন দুর্ঘটনা ঘটিবার সম্ভাবনা না থাকে, সেই দিক্ দিয়া সেইরূপে অবতীর্ণ হওয়াই বিধেয়।পঞ্চম নিয়ম
বাষ্পীয় রথের পথের এক পার্শ্ব হইতে অপর পাশে গমন করা কর্ত্তব্য নহে। যদি নিতান্ত আবশ্যক হয়, তাহা হইলে, অতি সাবধানে সতর্ক হইয়া গমন করা বিধেয়।ষষ্ঠ নিয়ম
যে সকল ব্যক্তি বাষ্পীয় রথে আরোহণ করিবার বাসনায় কোন আড্ডায় গিয়া প্রতীক্ষা করিয়া থাকে, তাহাদিগের অতি সাবধানে বিশিষ্টরূপ সতর্ক হইয়া থাকা আবশ্যক।সপ্তম নিয়ম
যে সময়ে বাষ্পীয় রথ চলিয়া যায়, সে সময়ে রথারোহীদিগের মধ্যে কাহারও কোন সামগ্রী পথের মধ্যে পড়িয়া গেলে, তাহা তুলিয়া লইবার নিমিত্ত, ভূতলে অবরোহণ করা উচিত নহে।অষ্টম নিয়ম
বাষ্পীয় রথ সকল যেরূপ শ্রেণি-বদ্ধ হইয়া চলিয়া যায়, ইদানীং অপর সাধারণ সকলেই তাহা দৃষ্টি করিয়াছেন। তন্মধ্যে সর্ব্বাগ্রবর্ত্তী ও সর্ব্ব-পশ্চাদ্বর্ত্তীরথে আরোহণ করিলে, অধিক বিঘ্ন ঘটিবার সম্ভাবনা। অতএব, যদি মধ্যবর্ত্তী রথ ক্রেয়া করিবার উপায় থাকে, তবে তাহাই ক্রেয়া করা উচিত।নবম নিয়ম
স্থানে স্থানে বাষ্পীয় রথের পথের নিম্ন অথবা উর্দ্ধ দিয়া লোক জন ও গাড়ী পাল্কী প্রভৃতি পার হইবার নিমিত্ত স্বতন্ত্র পথ প্রস্তুত হয়। কিন্তু কোন কোন স্থানে ঐ উভয় পথই ভূমিতলে একত্র মিলিত হইয়া চতুষ্পথ অর্থাৎ চৌমাতা হইয়া থাকে। হাওড়ায় লোকজন-গমনাগমনের পথ উর্দ্ধ দিয়া, এবং বালি, কোণনগর প্রভৃতি অনেক স্থানে নিম্ন দিয়া গিয়াছে। কিন্তু শালিখা ও শেওড়াপুলির পশ্চিমে উভয় পথই ভূমিতলে এক স্থানে মিলিত হইয়াছে; তন্মধ্যে কোন পথ অধঃ বা উর্দ্ধ দিয়া যায় নাই। এরূপ স্থানে গামানাগমন করিবার প্রয়োজন হইলে, অতি সাবধানে সতর্ক হইয়া গমন করা কর্ত্তব্য। দ্বারবানের অনুমতি গ্রহণ না করিয়া গমন করা উচিত নয়।দশম নিয়ম
বাষ্পীয় রথ সম্বন্ধীয় নির্দিষ্ট নিয়মনুসারে যে যে সময়ে যে যে স্থানে উহা স্থগিত করিবার বিধি আছে, তদ্ভিন্ন অন্য সময়ে অন্য স্থানে স্থগিত হইলে, তৎক্ষণাৎ উহা হইতে অবতরণ করা শ্রেয়ঃকল্প। কিন্তু অবতরণ করিবার সময়ে এই পুস্তকের লিখিত প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম নিয়ম পালন করিতে হইবে।একাদশ নিয়ম
যে পথে বাষ্পীয় রথ সচরাচর মনুষ্য ও পণ্য লইয়া গমনাগমন করে, সেই পথেই মধ্যে মধ্যে সংবাদ প্রেরণ ও কোন উপস্থিত প্রয়োজন সাধনার্থ অতিশীঘ্রগামী নৈমিত্তিক রথ প্রেরিত হইয়া থাকে। নিতান্ত আবশ্যক না হইলে, ঐ সকল অতিশীঘ্রগামী রথে আরোহণ করা কর্ত্তব্য নহে।দ্বাদশ নিয়ম
বাষ্পীয় রথ সংক্রান্ত যত দুর্দৈব ঘটে, তাহার মধ্যে রাত্রি-কালে ও কুজ্ঝটিকার সময়েই অধিক ঘটিয়া থাকে। অতএব, পার্য্যমাণে তত্তৎ সময়ে বাষ্পীয় রথে ভ্রমণ করা কর্তব্য নহে।ত্রয়োদশ নিয়ম
বাষ্পীয় রথের পথে অন্য গাড়ীতে আরোহণ করিয়া ভ্রমণ করা বিধেয় নহে।
এখানে বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্যণীয়।
প্রথমত, লেখক ষষ্ঠ নিয়মে “আড্ডা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন ইংরেজি স্টেশনের বাংলা হিসেবে। হিন্দিতে সম্ভবত এয়ারপোর্টের অনুবাদ হাওয়াই আড্ডা। অধুনা বাংলা ভাষায় “আড্ডা” শব্দটি কবে বর্তমান অর্থে এসে পড়লো সেটা নিয়ে গুগোল করে কিছু বোকা-বোকা প্রবন্ধ ছাড়া কিছু পেলাম না।
দ্বিতীয়ত, অষ্টম নিয়মে “ক্রেয়া” শব্দের ব্যবহার হয়েছে। বাক্যটি এরকম “যদি মধ্যবর্ত্তী রথ ক্রেয়া করিবার উপায় থাকে, তবে তাহাই ক্রেয়া করা উচিত।“ ক্রেয়া শব্দের ইংরেজি Hire । ধারণা করা যায় উপমহাদেশে রেল চালুর প্রথম দিনগুলোতে কোন ক্ষেত্রে কোন শব্দ ব্যবহার করা হবে সেটা সবাই ঠিকঠাক ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। বর্তমান অষ্টম নিয়মটি বাংলা-ইংরেজির মিশেলে এভাবে লেখা হতে পারতোঃ
সকলে খেয়াল করেছেন যে ট্রেনের বগিগুলো একটির পর একটি সারিবদ্ধ হয়ে চলাচল করে। এর মধ্যে প্রথম বগি ও শেষ বগিতে দূর্ঘটনা ঘটলে বিপদের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদি সম্ভব হয় তাহলে টিকেট কাটার সময় মাঝামাঝি বগিগুলোতে সিট রিজার্ভ করে নেয়া উচিৎ।
বইতে অক্ষয়কুমার ভাড়া শব্দটি ব্যবহার করেছেন। টিকিট শব্দটিরও উল্লেখ আছে।বইয়ের একদম শেষে ট্রেনের সময়সূচী ও ভাড়ার সারণী জুড়ে দেয়া আছে। সেখানে দেখা যায় হাওড়া থেকে রাণীগঞ্জ যেতে সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগে। ট্রেনের প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী ও তৃতীয় শ্রেণী রয়েছে। স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে এটা পড়েছি রবীন্দ্রনাথ একবার অসুস্থ্য আত্মীয়কে দেখতে তৃতীয় শ্রেণীতে চড়ে কোথাও গিয়েছিলেন।
সর্বমোট ২২ পাতার বইটি আমার মতো আর সবার জন্য বেশ আগ্রহউদ্দীপক। অক্ষয়কুমারের লেখা বলে আমার জন্য বইটি একটু আলাদা মনোযোগও পেয়েছে। এর কারণ অবশ্যই বইটির লেখন অক্ষয়কুমার। অক্ষয়কুমার আধুনিক যুগে বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম বিজ্ঞান বইগুলোর লেখক। অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, চন্দ্রগ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, আগ্নেয়গিরিসহ অসংখ্য পরিভাষার জনক তিনি। অবদানের তুলনায় অক্ষয়কুমার নিয়ে আলোচনা এই যুগে সামান্য।
ফুটনোট
১। কাঞ্চীপুর বর্দ্ধমান ছয় মাসের পথ।
ছয় দিনে উত্তরিল অশ্ব মনোরথ॥
– বিদ্যাসুন্দর।