তারিখবাচক সংখ্যাশব্দে প্রত্যয়ের ব্যবহার

প্রায়ই এখানে ওখানে তারিখ শব্দ লেখার ব্যাকরণশুদ্ধ নিয়ম নিয়ে বিবাদের মধ্যে পড়তে হয়। এই বিবাদের একটা পক্ষ থাকে যারা মিডিয়াতে লিখছে এই “যুক্তি”তে তারিখ শব্দ প্রত্যয় ছাড়া লেখা যাবে এরকমটা বলতে চান। বলাবাহুল্য, আমি শুদ্ধ-অশুদ্ধ নিরূপণে ব্যাকরণ বই বা আধুনিক অভিধান খুলে পড়ে দেখতে আগ্রহী। সম্প্রতি এরকম এক তর্কে জড়িয়ে পড়ার পর মনে হলো এ বিষয়টা নিয়ে আমার বক্তব্যগুলো লিখে রাখা দরকার। বারবার নতুন করে ব্যাখ্যা করার চাইতে একটা রেফারেন্সসহ লেখা থাকলে সুবিধা।

আলোচ্য গোলযোগ ১ মে নাকি ১লা মে, ২১ ফেব্রুয়ারি নাকি ২১শে ফেব্রুয়ারি লেখা হবে এটা নিয়ে। নব্বুই দশকে বাংলাদেশে মিডিয়ার হাত ধরে তারিখবাচক সংখ্যাশব্দে প্রত্যয় বাদ দেবার চল শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ১লা মে না লিখে লেখা হচ্ছে ১ মে। এই বিষয়ে সবসময় উচ্চকণ্ঠ রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। তিনি তাঁর ‘যা কিছু ব্যাকরণ নয়’ [১] বইতে লিখেছেন,

ইদানীং কোনো অজ্ঞাত কারণে (হতে পারে হিন্দির অনুকরণে) উভয় বাঙলার কোনো কোনো লেখক বিশেষ বিশেষ বাঙলা দৈনিক ও সাপ্তাহিকের সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করে তারিখ শব্দ ব্যবহার করেন না, সংখ্যাশব্দকেই তারিখ শব্দ হিসেবে চালিয়ে দেন। এসব পত্রিকার অনেক পাঠক ইতিমধ্যে এ ধরনের ভাষাপ্রয়োগের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ তাদের ভাষাপ্রয়োগে হয়ে যাচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি বা পয়লা বৈশাখ হয়ে যাচ্ছে ১ বৈশাখ।

১ বৈশাখ বা ২১ ফেব্রুয়ারি-জাতীয় প্রয়োগ বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল (এ যুক্তি যারা দিতে চান, তাঁদের উদ্দেশে আমার একটি কথা বলার আছেঃ ভাষা অবশ্যই বদলায়, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খেয়ালখুশি অনুসারে বদলায় না। সংখ্যাশব্দের সঙ্গে লা, শে, ই, ঠা ইত্যাদি প্রত্যয় যোগ করে তারিখ শব্দ গঠন করা বাংলা ভাষার নিয়ম। সংখ্যাশব্দের সঙ্গে কোনো প্রত্যয় যুক্ত না করা হিন্দি ভাষার নিয়ম।

শিশির ভট্টাচার্য্য আরোও জানাচ্ছেন এই “উলঙ্গ তারিখ” লেখার চল শুরু করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা [৩]। আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে এই চল বাংলাদেশে শুরু করেছে বাংলাদেশের প্রথম আলো।[৩]

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ বইতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বাংলা ব্যাকরণে বিশেষণকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ অর্থনির্ভর, ব্যুৎপত্তিনির্ভর এবং অন্বয়নির্ভর।

অর্থনির্ভর বিশেষণ দুই প্রকারঃ নামবিশেষণ ও অতিবিশেষণ। নামবিশেষণকে আবার ৯ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হলো সংখ্যাবাচক নামবিশেষণ। সংখ্যাবাচক বিশেষণ তিন প্রকারঃ পূর্ণসংখ্যাবাচক, মোটামুটি সংখ্যার বিশেষণ ও ক্রমবাচক বিশেষণ। বাংলায় তারিখ লিখতে এই ক্রমবাচক বিশেষণের নিয়ম প্রযোজ্য।

বাংলায় মাসের দিন নির্দেশ করতে যে সংখ্যাশব্দ ব্যবহৃত হয় তা তারিখবাচক সংখ্যাশব্দ নামে পরিচিত। তারিখবাচক সংখ্যাশব্দগুলো এ রকমঃ

১। এক থেকে চার তারিখঃ পয়লা, দোসরা, তেসরা, চৌঠা
২। পাঁচ থেকে আঠারো তারিখঃ সখ্যার শেষে -ই প্রত্যয় যোগ করে এই তারিখবাচক শব্দগুলো গঠিত হয়। যেমনঃ পাঁচই, ছয়ই, সাতই, আটই।
৩। উনিশ থেকে বত্রিশ তারিখঃ সংখ্যার সাথে -এ প্রত্যয় যোগ করে এই তারিখবাচক সংখ্যাগুলি গঠিত হয়। যেমনঃ উনিশে, বিশে, একুশে, বাইশে।[৪]

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ এই তারিখবাচক সংখ্যাশব্দগুলো কীভাবে উচ্চারণ করা হবে সেটা বলা আছে।

সেখানে [৫] দ্রষ্টব্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে “অ্যাক বৈশাখ, অ্যাগারো জৈষ্ঠ্য … প্রভৃতি উচারণ অশুদ্ধ”।

তথ্যসূত্র

১। যা কিছু ব্যাকরণ নয় – শিশির ভট্টাচার্য্য, বাংলা একাডেমী, ২০১৯।
২। ৭ই মার্চঃ ই-হীন হলেই শ্রীহীন! – শিশির ভট্টাচার্য্য
৩। বাঙলা বানান, ব্যাকরণ ও বানান সংস্কারঃ একটি পর্যালোচনা – শিশির ভট্টাচার্য্য
৪। প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ – রফিকুল ইসলাম, পবিত্র সরকার, মাহবুবুল হক (সম্পাদক), বাংলা একাডেমি ২০১৪।
৫। আধুনিক বাংলা অভিধান – বাংলা একাডেমি, ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *